Sunday, July 8, 2018

মানুষ কি আল্লাহর খলিফা? একটি ত্বাত্তিক বিশ্লেষণ...

আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু৷
---
সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, আমরা  শুধু তারই প্রশংসা করি এবং তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর উপর।
----
তথাকথিত রাজনৈতিক ইসলামিক দলের "পলিটিক্যাল লিডারগন" যুগে যুগে আল্লাহর কিতাব, রাসুলের হাদিসের অপব্যাখ্যা  করেছেন নিজেদের "রাজনৈতিক স্বার্থ "হাসিলের জন্য যার ধারাবাহিকতা আজও অব্যাহত রয়েছে! তেমনি একটি পলিটিক্যাল ব্যাখ্যা হল
"মানুষকে ডালাওভাবে আল্লাহর খলিফা" সাবস্থ্য করা!

"মানুষ কি আল্লাহর খলিফা" এ বিষয় টি যখন গতবছর একজন স্বনামধন্য জামাতি আলেম লাইভে এসে বেশ তালগোল পাকিয়ে  একপেশে ব্যাখ্যা প্রচার করছিল, তখন ই আমরা এর দালিলিক জবাব দিয়েছিলাম!কিন্তু ইদানিং সেই একই বিষয় নিয়ে আবারো ফেবুতে তর্ক বিতর্ক লক্ষ্য করছি! যেহেতু এটা আলেমদের আলোচনার বিষয় তাই আমি নিজ থেকে কিছু সংযোজন বা বিয়োজন না করে এবিষয়ে প্রখ্যাত মুফাসসির গণ, যুগ শ্রেষ্ঠ ওলামাগণের মতামত তুলে ধরব (ইনশা আল্লাহ)!

একটি রাজনৈতিক দলের কিছু আলেম ও তাদের প্রতিষ্ঠাতার থিউরি অনুযায়ী  "রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে বড় ফরয" বলে দাবি করার ফলে তারা কোরআনের কিছু আয়াতের পলিটিক্যাল ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে দেন! তার ই অংশ হিসেবে তারা বলেন যে, মহান আল্লাহ মানুষকে তাঁর রুবূবিয়্যাত বা প্রতিপালনের খিলাফাত বা প্রতিনিধির দায়িত্ব প্রদান করেছেন!যেহেতু রুবূবিয়্যাতের এ দায়িত্ব পালনই মুমিনের বড় ফরজ অতএব, এ দায়িত্ব পালনের জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা অপরিহার্য!
তাইতো শুধুমাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যত প্রকার বিদাতি তরিকা রয়েছে তার অনুসরণ করেই চলেছেন তাদের অনুসারীরা! মুলত রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কুরআন ও হাদীসের অন্যান্য বাণী দ্বারা স্পট কিন্তু নিম্নের আয়াতকে দলিল হিসেবে ব্যবহার করাটা এক্কেবারেই অপ্রাসঙ্গিক ও অপব্যাখার শামিল!কারণ এ আয়াতটির সাথে রাষ্ট্র  প্রতিষ্ঠার দায়িত্বের কোন সম্পর্কই নেই!

সুরা আল-বাক়ারাহ -৩০ নং আয়াতে মহান আল্লাহতালা বলেন---

وَاِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلٰٓٮِٕكَةِ اِنِّىْ جَاعِلٌ فِى الْاَرْضِ خَلِيْفَةًؕ قَالُوْٓا اَتَجْعَلُ فِيْهَا مَنْ يُّفْسِدُ فِيْهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَآءَۚ وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَـكَ‌ؕ قَالَ اِنِّىْٓ اَعْلَمُ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ

আর (স্মরণ কর) যখন তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদেরকে  বললেন, ‘আমি পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি,স্থলাভিষিক্ত)   সৃষ্টি করছি।’ তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? অথচ আমরাই তো আপনার সপ্রশংস মহিমা কীর্তন ও পবিত্রতা ঘোষণা করি।’ তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি যা জানি তা তোমরা জান না।’

উক্ত আয়াতে মহান আল্লাহতালা বলেছেন যে, তিনি আদমকে পৃথিবীতে ‘খলীফা’ প্রতিনিধি  বা স্থলাভিষিক্ত হিসেবে প্রেরণ করবেন, কার প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত করবেন  তা বলেন নি। প্রশ্ন জাগতে পারে- এখানে কার "খলিফা" সৃস্টির কথা বলা হয়েছে?
১.স্বয়ং আল্লাহতালার খলিফা?
২.পূর্ববর্তী জাতির খলিফা?
৩.উভয়টি?

এক্ষেত্রে উক্ত আয়াত থেকে মুফাসসিরগণ তিনটি মত ব্যক্ত করেছেন--

১. ইবনু আব্বাস (রা), ইবনু মাসঊদ (রা) প্রমুখ সাহাবীর মতে এখানে ‘স্থলাভিষিক্ত’ বলতে পূর্ববর্তী জ্বিন জাতির স্থলাভিষিক্ত বুঝানো হয়েছে!
রেফারেন্স -আল জামি লি আহকামিল কোরআন ১/২৬৩-২৭৫

 (২) ইবনু যাইদ ও অন্যান্য কোনো কোনো মুফাস্সিরের মতে এখানে ‘খলীফা’ বা স্থলাভিষিক্ত বলতে বুঝানো হয়েছে যে, আদম সন্তানগণ এক প্রজন্মের পর আরেক প্রজন্ম পৃথিবীতে বসবাস করবে এবং পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ববর্তীদের স্থলাভিষিক্ত হবে।
রেফারেন্স -তাফসির ইবনে কাসির ১/৭০-৭১?

(৩) ইমাম তাবারী ও অন্যান্য কতিপয় মুফাস্সির বলেন যে, এখানে খলীফা অর্থ আল্লাহর খলীফাও হতে পারে। অর্থৎ আদম ও তাঁর সন্তানগণ পৃথিবীতে আল্লাহর নিয়ম-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরই স্থলাভিষিক্ত।
রেফারেন্স --তাফসির তাবারী- ১/১৯৯-২০০
---
প্রথমেই জেনে নিন "খলিফা " শব্দের অর্থ---
খলীফা অর্থ  "প্রতিনিধি ‘স্থলাভিষিক্ত’, উত্তরাধিকারী বা ‘গদ্দিনশীন’, যিনি অন্যের অনুপস্থিতিতে তার স্থলে অবস্থান বা কর্ম করেন। খলীফা শব্দ, এর বহুবচন এবং এর ক্রিয়াপদ কুরআন কারীমে প্রায় ২০ স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। এ সকল ব্যবহারের আলোকে সুস্পষ্ট যে, খলীফা বলতে পূর্ববর্তী প্রজন্মের স্থলাভিষিক্ত বুঝানো হয়। যেমন-
প্রখ্যাত আরবী অভিধান لسان العربএ বলা হয়েছে : الخليفة: الذي يستخلف ممن قبله، والجمع: خلائف. “খলীফাহ: যে তাঁর পূর্ববর্তী কারো স্থলাভিষিক্ত হয়।
 তাফসীরে রাযীতে বলা হয়েছে: الخليفة : من يخلف غيره ويقوم مقامه “যে অন্য কারো স্থলাভিষিক্ত হয়ে তার প্রতিনিধিত্ব করে সে ই খলীফাহ” ।

---
তাফসীর আহসানুল বায়ানে বলা হয়েছে---خَلِيفَة
(খলীফা) এর অর্থ এমন জাতি যারা একে অপরের পরে আসবে। পক্ষান্তরে 'মানুষ দুনিয়াতে আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধি' এ কথা বলা ভুল।এজন্যই কুরআনের ব্যবহারের আলোকে প্রথম ও দ্বিতীয় মতই অধিক গ্রহণযোগ্য। (সুরা বাকারা-৩০ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)

তৃতীয় মতটির বিষয়ে প্রথম যুগের অনেক আলিম আপত্তি করেছেন। তাঁরা বলেছেন যে, মানুষকে আল্লাহর খলীফা বলা ইসলামী বিশ্বাসের পরিপন্থী। কারণ, কারো মৃত্যু, স্থানান্তর বা অবিদ্যমানতার কারণেই তার স্থলাভিষিক্ত, গদ্দিনশীন বা খলীফার প্রয়োজন হয়। আর মহান আল্লাহর তো এরূপ কোনো প্রয়োজনীয়তা থেকে মহা পবিত্র। কুরআনে কোথাও মানুষকে ‘আল্লাহর খলীফা’ বলা হয় নি। তাছাড়া  হাদীসে বলা হয়েছে যে, আল্লাহই মানুষের খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত হন। যেমন সফরের দু‘আয় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন: ‘‘আপনিই সফরে (আমাদের) সাথী এবং পরিবারে (আমাদের) খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত।
রেফারেন্স -সহীহ মুসলিম ২/৯৭৮

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহিমাহুল্লাহ ও শাইখুল ইসলাম  ইমাম ইবনে কাইয়ুম রাহিমাহুল্লাহ সমস্ত দলিল,আদিল্লাকে সামনে রেখে বলেন-- মানুষকে আল্লাহর খলিফা(প্রতিনিধি, স্থলাভিষিক্ত)  বলাটা ভুল যেহেতু আল্লাহতালা অবিদ্যমান নন ! বরং " এক জাতি আরেক জাতির, এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের খলিফা"এটাই দলিলের আলোকে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত!
বিস্তারিত তাহকিক দেখুন--- http://www.ahlalhdeeth.com/vb/showthread.php?t=246960

ফাতহুল কাদিরে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, আদম-সন্তানের ব্যাপারে ফিরিশতাগণ কিভাবে জানলেন যে তারা ফিতনা ও ফাসাদ সৃষ্টি করবে? এই অনুমান তাঁরা মানুষ সৃষ্টির পূর্বে যে (জ্বিন) সম্প্রদায় ছিল তাদের কার্যকলাপ দ্বারা অথবা অন্য কোন ভাবে করে থাকবেন। কেউ কেউ বলেছেন, আল্লাহ তাআলাই বলে দিয়েছিলেন যে, তারা এ রকম এ রকম কাজও করবে। তাঁরা বলেন, বাক্যে কিছু শব্দ উহ্য আছে, আসল বাক্য হল, {إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيْفَةً يَفْعَلُ كَذَا وَكَذَا} "আমি পৃথিবীতে এমন প্রতিনিধি বানাবো যে এ রকম এ রকম করবে।"
----

বর্তমানে একটি রাজনৈতিক দলের কিছু অনলাইন এক্টিভিটিজ তাদের গুরুদের ভ্রান্তিগুলো আড়াল করতে "খলিফা" শব্দকে একচেটিয়া "প্রতিনিধি" অর্থে ব্যবহার করছেন অথচ এর ভাবার্থ কিন্তু একই!এরা সুকৌশলে "ঘোলা পানিতে মাছ শিকার" করার অপচেষ্টা করছেন!
আল্লাহর খলীফা' শব্দটার আরবী করলে হয় 'خَلِيفَةُ اللهِ', এখানেঃ
خَلِيفَةُ هو مضاف
اللهِ وهو مضاف إليه
এই শব্দটা কোরআনের কোন জায়গায় পাবেন না। কিন্তু
'রাসূলের খলীফা' (خَلِيفَةَ رَسُولِ اللَّهِ) শব্দটা হাদীছের কিতাবগুলির ২১৫ জায়গায় পাওয়া যায়।

আপনারা নিশ্চয় ই জানেন হাদিসের পরিভাষায় খলিফা আবু বক্কর রাদি: কে কখনোই খলিফাতুল্লাহ(আল্লাহর খলিফা) বলা হত না বরং খলিফাতু রাসুলিল্লাহ (রাসুলের খলিফা) বলা হত! কিন্তু কেন খলিফাতুল্লাহ বলা হত না তার উত্তর আশা করি তারা দিবেন!

এতদসত্ত্বেও পরবর্তীকালে এআয়াতের তাফসীরে তৃতীয় মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করে! শিয়াগণ এ ব্যাখ্যাকে তাদের মতের দলীল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তাদের মতে মানুষ আল্লাহর খলীফা। আর আল্লাহর খিলাফাতের পরিপূর্ণতা ইমাম বা রাষ্ট্র প্রধানের মধ্যে বিদ্যমান থাকতে হবে। এজন্য তাদের বিশ্বাস অনুসারে ইমাম আল্লাহর গাইবী জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী এবং তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বলে গণ্য।
(ইসলামের নামে জংগীবাদ বইয়ের দ্রষ্টব্য )

শুধু শিয়াগন ই তৃতীয় মতটিকে "তারজিহ" দিয়ে প্রচার,প্রসার করেন নি বরং সুন্নি নামধারী  বর্তমান যুগে (মুসলমান) সমাজে আত্মঘাতী বোমা হামলা, গুপ্ত হত্যা ও তাকফীরের মতো বিপর্যয়ের গুরু সাইয়েদ কুতুবও এই মতকে ডালাওভাবে প্রচার, প্রসার করেছেন!

এছাড়া দ্বীন কায়েম, খিলাফত প্রতিষ্ঠা, ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের ভুল ব্যখ্যা দিয়ে কথিত ‘ইসলামিক আন্দোলন’ এর মতাদর্শ প্রচারকারী মাওলানা মওদুদিও এক ই আকিদা পোষণ করতেন! মওদুদি সাহেব জীবিত থাকাকালীন সময়েই যখন বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ আলেমেদ্বীন আল্লামাহ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ তার এই ভ্রান্ত আকিদা সম্পর্কে জানতে পারেন তখনই মওদুদি সাহেবকে চিঠি দিয়েছিলেন তার আকিদা সংশোধণের জন্য (যা মাকতাব আস শামেলা & আল ইফতা সাইটে এখনো রয়েছে)!যদিও তিনি মৃত্যু অবধি তার আকিদা সংশোধন করেছেন বলে কোন প্রমান পাওয়া যায় নি!
 লিংক----
President of the Islamic University in Medinah
'Abdul `Aziz Bin `Abdullah Ibn Baz
source: [url=http://alifta.com/Fatawa/FatawaChapters.aspx?View=Page&PageID=402&PageNo=1&BookID=14]Ibn Baz fatwas[/url]

সুতরাং, সমস্ত দলিলাদির আলোকে বিশুদ্ধ মত হল "মানুষ আল্লাহর খলীফাহ’ এই অভিমতটিই  অগ্রহণযোগ্য ও বর্জনীয়  বরং তাফসীর ইবনে কাসির,তাফসীর আহসানুল বায়ান,ফাতহুল কাদির,আল জামিয়'লি আহকামিল কোরআন,ইমাম ইবনে তাইমিয়া, ইমাম ইবনে কাইয়ুম রাহিমাহুম্মাহর তাহকিক,আল্লামাহ বিন বাযের অভিমত সহ পূর্ববর্তী ও এই শতাব্দীর জমহুর আলেম, মুহাদ্দিস, মুফাসসিরদের মতটিই অধিক বিশুদ্ধ এবং প্রধান্যযোগ্য!

আশা করি,  আমাদের  এই দীর্ঘ আলোচনাতে  পাঠকগণের  এ বিষয়টি নিয়ে ধোয়াশা দূর হয়েছে!
আল্লাহতালা আমাদের সকলকে যাবতীয় ফিতনা থেকে হেফাজত করুণ-- আমিন।

কলাম---আখতার বিন আমীর।
ছালালাহ---ওমান।

No comments:

Post a Comment

আহ্লুস সুন্নাহ

▌বিবাহ : কিছু পরামর্শ - [ করনীয় ও বর্জনীয় ]

❒ প্রারাম্ভিকা, বর্তমানে যুবক যুবতীদের অবস্থা হল, তারা পাপাচার করেও পরিতৃপ্ত হচ্ছে না বরং পাপাচারের নিত্য-নতুন পদ্ধতি খুঁজে বেড়াচ্ছে।...